আলো দূষণ ও শব্দদূষণ নিয়ে আলোচনা
একেবারেই কম। কিন্তু এ দুটো দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য নীরব ঘাতক। উন্নয়নের গতির
সঙ্গে সঙ্গে এ দূষণ বাড়ছে। মানুষ্যসৃষ্ট কারণেই ফলাফল ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে।
অপ্রয়োজনীয় কারণে বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হচ্ছে। অধিক ভোগ-বিলাসিতার জন্য আলো
দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে শব্দদূষণের মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী।
আলো দূষণ উন্নত বিশ্বে বেশি।
শব্দ প্রাণিকুলের
অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু এর সীমা থাকা দরকার, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবল (শব্দের নিম্নতম পরিমাপক) সাময়িকভাবে শ্রবণশক্তি
নষ্ট করে দেয় আর ১০০ ডেসিবেল শব্দ হলে চিরতরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজধানী ঢাকার অনেক স্থানে ১০৭ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ থাকে বা
আছে। আল্লাহ মনে হয় আমাদের সহ্যক্ষমতা বেশিই দিয়েছেন! প্রতিনিয়ত ভেজাল খাদ্য খেয়ে
সহ্যক্ষমতা মনে হয় বেড়েই গেছে। না হলে শব্দদূষণে আরো ক্ষয়ক্ষতির হার বেড়ে যেত।
শব্দদূষণের সঙ্গে বধিরতার সম্পর্ক রয়েছে। আকস্মিক তীব্রশব্দ কানের ভয়াবহ ক্ষতি
করে। সম্পূর্ণ বধিরও করতে পারে। আমাদের যানবাহন ও শিল্প-কারখানা থেকে ভয়াবহ
শব্দদূষণ হয়। শব্দদূষণের ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ
কমে যাওয়া রোগ হয়ে থাকে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট, মাথাধরা, বমি বমি ভাব ও মানসিক
অস্বাভাবিবকতা হতে পারে। একটানা গাড়ির শব্দ বা উচ্চশব্দ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
পুরো ঢাকা শহরটাই এখন ভয়াবহ শব্দদূষণের শিকার। রাজধানীর সব এলাকায় শব্দ সহ্যসীমার
অনেক বেশি রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণমাত্রার দ্বিগুণ বা তিন গুণ পর্যন্ত
রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ লোকের শ্রবণশক্তি কমে যাবে বলে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ)
বিধিমালা-২০০৬-এ বলা হয়েছে, শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব ও ক্ষতিকরের হাত থেকে
সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা আছে। এ আইনে বলা আছে, প্রতি ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন
বা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কী কী করবে। এসব কর্তৃপক্ষের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন এলাকা
শনাক্ত করতে হবে। যেমন নীরব এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা,
আবাসিক এলাকা প্রভৃতি। নীরব এলাকায় থাকবে হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল
প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত হবে। ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিলবোর্ড,
সাইনবোর্ড, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে সজাগ করার কথা বলা আছে। এসব থাকলে জনগণ
কোথায় কী করতে হবে জানবে। কিন্তু এই আইন সম্পর্কে তেমন কোনো প্রচার নেই। এ আইন
বাস্তবায়ন করলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আইনের প্রচার ও
বাস্তবায়ন, সচেতনতা সৃষ্টি, হর্ন বাজানো থেকে বিরত, জেনারেটর ও যন্ত্রপাতির শব্দ
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করতে হবে বা রাখতে হবে। হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর ব্যাপারে
আদালতের নির্দেশনা আছে, যা কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। শিল্প এলাকায় কম শব্দ
উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে। যন্ত্রপাতিগুলো নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে।
সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যথাসম্ভব মাইকের ব্যবহার কম করতে হবে। এড়িয়ে
চলতে পারলে খুব ভালো হবে। না হলে কম শব্দ সৃষ্টি করে এমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে
হবে। জাপানিরা বা উন্নত দেশের লোকরা কথা কম বলেন। কাজ বেশি করেন। প্রয়োজন ছাড়া কথা
বলেন না। আমরা ধীরে ধীরে এ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি। এদিকে কৃত্রিম আলোতে বিশ্ব
ভরে গেছে। বাংলাদেশও ভরে যাচ্ছে। শহরে রাত আর দিনের পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে পড়ে
অনেক সময়। অনেক শহর কৃত্রিম আলোয় দিনের ফ্লেভার পায়। উন্নত দেশের বেশির ভাগ শহর তো
এ রকমই। কায়রোকে তো বাজারের শহর বলা হয়। রাতের বেলায় জাঁকজমক বেশি হয়। বাংলাদেশের
প্রধান শহরগুলো এমনকি জেলা বা মফস্বলের অনেক শহরে আলোর খেলা চলে রাতে। কসমেটিক বা
বিপণিকেন্দ্রগুলোয় রাতেই উপচে পড়া ভিড় হয়। কর্মব্যস্ত মানুষ রাতেই বাজার বা
মার্কেট করতে চাই। বাচ্চারাও কৃত্রিম আলোর নাচুনিতে মুগ্ধ হয়ে অভিভাবকদের বাইরে
যাওয়ার জন্য প্রভাবিত করে। এ সংখ্যা এখন বেড়েই চলেছে।
দেখা যায়, অনেক শহরে
দিনের আলোর চেয়ে রাতে কৃত্রিম আলোয় আকাশ জ্বলজ্বল করে। রাতের বেলা আকাশ বা
গ্রহ-তারা কৃত্রিম আলোকচ্ছটায় পরিষ্কার দেখা যায় না। লোকালয়ের অনেক দূরে দেখতে
যেতে হয়। তখনই আমরা ধরে নেব আলোক দূষণ চরম মাত্রায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের
৮৩ শতাংশ শহর আলো দূষণের শিকার। আমেরিকার আর ইউরোপের শতভাগ (৯৯ শতাংশ) শহর আলো দূষণের
শিকার। কাতার, কুয়েত, সিঙ্গাপুর সবচেয়ে বেশি আলো দূষণের শিকার। আর দক্ষিণ আফ্রিকার
সাদসহ দরিদ্রপীড়িত দেশ কম আলো দূষণের শিকার। দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নের একই গতিতে আলো
দূষণের হার বেড়েই যাচ্ছে। জার্মানির কোলন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হ্যারাল্ড বার্ডেন
হাগেন পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান থেকে বলেছেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই রাতের আলোর নেতিবাচক প্রভাব
রয়েছে। মানুষের স্বাস্থ্য অন্যদিকে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি। এ ছাড়া রাতের কৃত্রিম
আলোর ছটা আকাশের গ্রহ-তারাকেও ম্লান করে দিতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, এটা মানুষের
ওপরও প্রভাব ফেলে। এটি বডি-ব্লক ওলটপালট করে দিতে পারে। রাতের কৃত্রিম আলোর কারণে
স্তন ও প্রস্ট্রেট ক্যানসারের আশঙ্কাও বাড়িয়ে দেয়।
যেসব প্রাণী অন্ধকারে
চলাচল করে, তাদের জন্য কৃত্রিম আলো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বাদুড়, লক্ষ্মীপেঁচা,
হুতুমপেঁচা, শিয়াল, বনবিড়াল প্রভৃতি প্রাণীর চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করে। বংশবিস্তার
কমে যায়। সোডিয়াম আলোর কারণে অনেক প্রাণী বাসস্থানের পরিবেশ নষ্ট হয়। অন্ধকারে চলা
বা নিশাচর প্রাণীরা খাদ্যসংকটে পড়ে। পোকামাকর, কীটপতঙ্গের জীবনযাত্রা দিন-রাতের
নিয়তির ওপর নির্ভরশীল। ফলে জিববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের
ভারসাম্য নষ্ট হয়। এলইডি প্রযুক্তি আসার পর আলোর ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। ভিজিবল
ইনফ্লায়েড ইমেজিং রেডিওর (ভিআইআইএস) মাধ্যমে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০১২ সালের
তুলনায় ২০১৬ সালে কৃত্রিম আলোর তীব্রতা বেড়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত। এতে ঘুম
কেড়ে নিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাস্তুতন্তে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ঠিক রাখার জন্য
অন্ধকার খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক কীটপতঙ্গের খাবারের জোগান উদ্ভিদ থেকেই হয়ে
থাকে। অনেক উদ্ভিদের ফুল ফোটে অন্ধকারে। উদ্ভিদ থেকে বিষাক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড
নিঃসারণ হয়। পরাগায়ণ হয় রাতের বেলায়। নিশাচর কীটপঙ্গের মাধ্যমে অনেক উদ্ভিদের
পরাগায়ণ হয়ে থাকে, যা রাতের বেলায় হয় বা অন্ধকারে হয়। আলোর প্রভাবে প্রকৃতির এই
চেইনও বিঘিœত হচ্ছে।
বিশ্বে উৎপাদিত
বিদ্যুতের এক-চতুর্থাংশ কৃত্রিম আলো তৈরিতে ব্যবহৃত হয় বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন।
অতিরিক্ত আলোর এলাকায় বিলবোর্ডের আলোর ঝলকানিতে গাড়ির চালক নিশানা ভুল করতে পারেন।
আলোকসংকেত নাও দেখতে পারেন। আমাদের রাজধানীর বা বড় শহরের রাস্তার দুধারে অনেক আলোক
বিলবোর্ড আছে। কৃত্রিম আলোর জন্য যে শক্তি ব্যবহার করা হয়, তার ৩০-৬০ ভাগ পর্যন্ত
অপচয় হয় বলে জানা যায়। সড়কবাতি, বিলবোর্ড ইত্যাদি ব্যবহারের প্রয়োজনে আলো যাতে কম
ছড়ায়, তা খেয়াল রাখতে হবে। অনেক দেশেই আবিষ্কৃত (যেমন জার্মানি) হয়েছে
লক্ষ্যবস্তুতে আলোকিত করার বাল্ব। এতে চারদিকে আলো ছড়িয়ে যাবে না। কিন্তু আমাদের
অনেক অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য থাকে লোক দেখানো বা জাঁকজমক করা। এতে আলোর অপচয় হবে। আলো
দূষিত হবে। সচেতনতাই কেবল পারে আমাদের দেশে শব্দদূষণ ও আলোক দূষণ কমাতে। এ
ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আমরাও এগিয়ে আসব। ব্যর্থ হলে আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই খারাপ
হবে।
0 comments: