কুকুর হয়তো মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু,
কিন্তু এই জন্তুটি এখন বন্যপ্রাণীর জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন প্রধানত কুকুরের কারণে প্রায় এক ডজন পাখী এবং পশুর প্রজাতি বিলীন হয়ে গেছে।
শুধু সেটাই নয়,
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের পরিবেশ বিষয়ক সংবাদদাতা নভিন সিং খাড়কা তাদের গবেষণাকে উদ্ধৃত করে
বলছেন সারা বিশ্বে প্রায় একশ প্রজাতির পাখী এবং জীব-জন্তু কুকুরের কারণে হুমকিতে পড়েছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ-বাদীরা বলছেন, বুনো এবং
ঘর-পালানো বেওয়ারিশ কুকুরের কাছ থেকে এই
হুমকির কথা নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ
চিলিতে সাম্প্রতিক এক
গবেষণার উপসংহারে বলা
হয়েছে, বন্যপ্রাণী বাঁচাতে বুনো বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেছে, অনেক কুকুর মালিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন
না এবং তারা তাদের কুকুরকে ছেড়ে রাখেন ।
চিলির ঐ গবেষণায় জড়িত ছিলেন এডওয়ার্ডো সিলভা-রডরিগেজ। তিনি বিবিসিকে বলেন - তিন প্রজাতির হরিণ সহ অধিকাংশ বড় স্তন্যপায়ী জীবজন্তু কুকুরের হাতে নিয়মিত হেনস্থা হচ্ছে। অনেকসময় কুকুর তাদের মেরে খেয়ে ফেলছে।
১০০ কোটি কুকুর :
গৃহপালিত, বেওয়ারিশ এবং
বুনো মিলিয়ে সারা বিশ্বে কম-বেশি ১০০ কোটি কুকুর আছে।
এগুলোর কত শতাংশ ঘর-পালানো বেওয়ারিশ এবং
বুনো - সে সম্পর্কে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই,
তবে এদের সংখ্যা বাড়ছে।
"বিষয়টি খুবই উদ্বেগের," বিবিসিকে বলেন পরিবেশবাদী সংস্থা আইইউসিএনের পিয়েরো জেনোভেসি।
"মানুষের সংখ্যা যত
বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে কুকুরের সংখ্যা। এই সমস্যা আরো
তীব্রতর হতে পারে।।"
কুকুরের হুমকিতে পড়া বন্যপ্রাণী :
বুনো এবং বেওয়ারিশ কুকুরের কারণে হুমকিতে পড়েছে প্রায় ২০০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, যাদের অর্ধেকই স্তন্যপায়ী, ৭৮টি পাখী, ২২টি সরীসৃপ এবং
তিনটি উভচর।
এদের মধ্যে ৩০টি প্রজাতি বিলীন হওয়ার হুমকিতে। ৭০টির অবস্থা বিপজ্জনক।
সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে এশিয়ার কিছু অঞ্চল, মধ্য এবং
দক্ষিণ আমেরিকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব
এলাকায় প্রচুর বেওয়ারিশ কুকুর রয়েছে, যেগুলো বড়
ধরণের বিপদ তৈরি করেছে।
নানামুখী প্রভাব :
কুকুর প্রধানত পাঁচভাবে বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করছে।
তারা বন্যপ্রাণীকে হত্যা করছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে, বন্যপ্রাণীর ভেতর রোগ ছড়াচ্ছে, খাবারে ভাগ বসাচ্ছে এবং
কাছাকাছি প্রজাতির সাথে যৌন সঙ্গম করে
বংশ বিস্তার করছে।
পোল্যান্ডে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বুনো কুকুর বনবিড়ালের গর্তে ঢুকে তাদের শিকার করা খাবার নিয়ে যাচ্ছে।
আরেক গবেষণা বলছে, নিউজিল্যান্ডে কোয়েল সহ
অন্তত আট ধরণের পাখী কুকুরের কারণে বিলীন হয়ে গেছে।
কুকুরের তাড়া :
কুকুর বন্যপ্রাণীর জন্য ভীতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার
বহু ভিডিও নমুনা রয়েছে।
একটি দেখা যাচ্ছে - তিব্বতে একটি স্নো লেপার্ড বা চিতাবাঘকে তিনটি বুনো হয়ে যাওয়া কুকুর ঘিরে ধরেছে। আরেকটিতে দেখা যাচ্ছে, তিনটি কুকুর একটি পোলার বিয়ারকে (মেরু ভালুক) কোণঠাসা করে
ফেলেছে।
চিলিতে এক গবেষণা বলছে, পুডু নামে ক্ষুদ্র প্রজাতির যত
হরিণকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়, তাদের ৭০ শতাংশেরই জখমের কারণ কুকুরের কামড়।
ব্রাজিলে ৩০টি জাতীয় উদ্যানের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহপালিত ছাড়া কুকুর ৩৭ ধরণের বন্যপ্রাণীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের রাজস্থানে, বিলীন হওয়ার হুমকিতে পড়া গ্রেট ইন্ডিয়ান বাসটার্ডস নামে বিরল একটি পাখীর প্রজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতে বাঘের জন্য সংরক্ষিত জঙ্গলগুলোতে কুকুর কতটা ঝুঁকি তৈরি করেছে, তা নিয়ে এখন একটি গবেষণা চলছে।
কুকুর এবং রোগবালাই :
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় কুকুর থেকে ছড়ানো রোগ
বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা ডব্লিউ ডব্লিউ এফের আর্নল্ফ কোনকে বিবিসিকে বলেন, "কুকুর অন্য প্রাণীকে মেরে খেয়ে ফেলছে - এটা যতটা না বিপজ্জনক তার
চেয়ে অনেক বিপজ্জনক হচ্ছে কুকর যেভাবে অন্য প্রাণীদের মধ্যে রোগ ছড়াচ্ছে, বিশেষ করে র্যাবিজ বা জলাতঙ্ক।"
ইথিওপিয়া, ভারত এবং
নেপালে র্যাবিজ ছাড়ানোর বহু নজির রয়েছে।
কী করা যাবে?
বুনো, বেওয়ারিশ ছাড়া কুকুরকে নিয়ে কী
করা যাবে?
মেরে এদের সংখ্যা কমানোর কথা কেউ
কেউ বললেও, তা
নিয়ে বিতর্ক-দ্বিমত রয়েছে।
কেলি ও মিয়ারা, যিনি পশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিচিত একটি মুখ, তার মতে,
মেরে কুকুরের সংখ্যা কমানো সম্ভব নয়। এক জায়গায় মারলে, পাশের জায়গা থেকে নতুন কুকুর এসে
শূন্যস্থান পূরণ করে
ফেলবে।
"সঠিক কুকুর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বেওয়ারিশ বুনো কুকুরের সংখ্যা কমাতে হবে। 'নিউট্রাল' করে
তাদের বাচ্চা জন্ম দেওয়া বন্ধ করা
যেতে পারে। নিয়মিত টিকা দিয়ে তাদের দ্বারা রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি কমানো যেতে পারে।"
কুকুরের কারণে বন্যপ্রাণীর প্রতি হুমকি কীভাবে কমানো যাবে - তা নিয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো কৌশল বিশ্বের কোথাও নেওয়া হয়নি।
সূত্র : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বিবিসি বাংলা
https://www.bbc.com/bengali/news-47227787